ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে, যার মূল ভিত্তি ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্যক্রম। এই কোম্পানির আগমন ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠা ও প্রাথমিক লক্ষ্য
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (British East India Company) ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের চার্টার অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কোম্পানির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনা করা, বিশেষত মসলা, রেশম, তুলা, চা এবং অন্যান্য মূল্যবান পণ্য আমদানি করা।
ভারতে প্রথম ব্রিটিশ আগমন ও বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন
১৬০৮ সালে ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্স প্রথমবারের মতো ভারত উপমহাদেশে আসেন এবং মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে বাণিজ্যের অনুমতি চাইতে যান। যদিও প্রথমদিকে তেমন সাফল্য মেলেনি, পরে ১৬১৫ সালে স্যার টমাস রো জাহাঙ্গীরের দরবারে বিশেষ অনুমতি নিয়ে আসেন। এর ফলে ব্রিটিশরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশরা সুরাট, মাদ্রাজ (১৬৩৯), বোম্বে (১৬৬৮), ও কলকাতা (১৬৯০) শহরে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে। বিশেষত কলকাতায় তারা ‘ফোর্ট উইলিয়াম’ নামক দুর্গ তৈরি করে, যা পরবর্তীতে ব্রিটিশদের শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
বাংলা, প্লাসি যুদ্ধ ও কোম্পানির রাজনৈতিক ক্ষমতা
১৭৫৭ সালের বিখ্যাত প্লাসি যুদ্ধ (Battle of Plassey) ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য একটি বড় বিজয়। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোম্পানির বর্ধিত ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী নবাবের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে কোম্পানি কেবল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং ভারতবর্ষে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
১৭৬৫ সালের দেওয়ানি লাভ ও রাজস্ব আদায়
১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার প্রদান করেন, যা ‘দেওয়ানি’ নামে পরিচিত। এর ফলে কোম্পানি রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারে এবং ভারতীয় অর্থনীতির ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের কারণ
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্রুত আধিপত্য বিস্তারের পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল:
- সামরিক শক্তি: ব্রিটিশদের সুসংগঠিত ও আধুনিক সেনাবাহিনী ভারতীয় শাসকদের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল।
- রাজনৈতিক কৌশল: বিভাজন ও শাসনের (Divide and Rule) নীতি অনুসরণ করে ভারতীয় রাজাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা।
- অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষা করা।
- প্রশাসনিক দক্ষতা: কোম্পানির সংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল।
১৭৭৩ সালের নিয়ন্ত্রণ আইন ও কোম্পানির পরিবর্তন
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কোম্পানির কার্যক্রমের উপর আরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাই ১৭৭৩ সালে ‘রেগুলেটিং অ্যাক্ট’ (Regulating Act) প্রণয়ন করা হয়। এর ফলে গভর্নর-জেনারেল পদ তৈরি করা হয় এবং প্রথম গভর্নর-জেনারেল হন ওয়ারেন হেস্টিংস। এই আইন কোম্পানির অনিয়ন্ত্রিত লুণ্ঠন ও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে কিছুটা ভূমিকা রাখে।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ও কোম্পানির পতন
১৮৫৭ সালের ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ (Indian Rebellion of 1857) ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রথম বৃহৎ আন্দোলন। বিদ্রোহের ফলে কোম্পানির বিরুদ্ধে জনরোষ বৃদ্ধি পায় এবং ব্রিটিশ সরকার সরাসরি শাসনভার গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ পাস করে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতকে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে নিয়ে আসে।
উপসংহার
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতবর্ষে আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা, যা উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে দেয়। শুরুতে একটি বাণিজ্যিক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও, কোম্পানি ধীরে ধীরে ভারতীয় ভূখণ্ডে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে এবং প্রায় দুই শতাব্দী ধরে শাসন চালায়। যদিও শেষ পর্যন্ত ভারতীয়দের প্রতিরোধের কারণে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে, তবুও তার রেখে যাওয়া প্রভাব ভারতবর্ষের ইতিহাসে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে।